অর্থমন্ত্রী গভর্নর ও এসইসির ভুলের মাসুল দিচ্ছেন ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসএইসি) ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী ৩৫ লাখ বিও একাউন্টধারীকে। যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। ৩৫ লাখ পরিবারে গড়ে ৬ জন করে প্রায় ২ কোটি মানুষ সরাসরি শেয়ারবাজারে ধসে পুঁজি হারিয়ে দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অল্পদিনের ব্যবধানে সূচক প্রায় আড়াইহাজার পয়েন্ট কমার পর গত ২০ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য শেয়ারবাজার বন্ধ করে দেয়া হলে অর্থমন্ত্রী ২১ জানুয়ারি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তার ও এসইসির ভুলের জন্য পুঁজিবাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান শেয়ারবাজার নিয়ে তার দায়-দায়িত্ব সরাসরি অস্বীকার করেই চলেছেন। যদিও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়তই গভর্নরকেও এ জন্য দায়ী করে চলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ নিয়ে বহুবার ঢিলও পড়েছে। গতকালও তারা একই মন্তব্য করেছেন। শেয়ার ধরে রেখে ডিভিডেন্ড খেয়ে পুষিয়ে নেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পরও গত মাত্র তিন কার্যদিবসে শেয়ারবাজারের সূচক আরও প্রায় ১৩০০ পয়েন্ট কমেছে। সবমিলে সূচকের পতন হয়েছে ৩৩৩৯ পয়েন্ট।
শেয়ারবাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে বাজারের সূচক যখন ধাই ধাই করে ওপরের দিকে উঠছিল তখনই একাধিকবার অর্থমন্ত্রী এটা দেশের অর্থনীতির সবল হওয়ার লক্ষণ বলে জানিয়ে বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তারও আগে শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগেরও সুযোগ তিনি দিয়েছেন বাজার চাঙ্গা করতে।
ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদের হার কমানো, নামমাত্র সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কলমানি মার্কেটের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থকে মার্চেন্ট ব্যাংক, এসএমই লোনের নামে লোন দিয়ে এবং মার্জিন লোন দিয়ে পুঁজিবাজারে খাটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন বাংরাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর। ব্যাংকের টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যাপকহারে পুঁজিবাজারে ঢুকছে জেনেও এটা রোধে গভর্নর কোনো ব্যবস্থা নেননি। সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামে ব্যাংগুলোও পুঁজিবাজারে ঢুকে বাজারকে স্ফীত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এসইসি বাজারে সিন্ডিকেটের ম্যানুপুলেশন বন্ধ, সূচকের ঊর্ধ্বগতি রোধে সময়মত পদক্ষেপ গ্রহণ, মনিটরিংসহ সার্বিক দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছে। বরং তারা ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সময় নানা ধরনের আদেশ-নিষেধ চাপিয়ে দিয়ে বাজারকে অতিমূল্যায়িত করতে সিন্ডিকেটের কারসারিজতে যেমন সহযোগিতা করেছে, তেমনিভাবে অতিমূল্যায়িত শেয়ার গণহারে বিক্রি করে দিয়ে বাজারের দ্রুত পতনের সময়ও তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে পতনকেও ত্বরান্বিত করেছে।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে শেয়ারবাজারের সিন্ডিকেট যখন মার্কেট থেকে তাদের টাকা তুলে নিয়ে যায়, প্রায় একই সময়ে হিসাব সমন্বয়ের কথা বলে ব্যাংকগুলোও তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়। আর তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেয়ার কথা বলে ব্যাংকগুলোকে কলমানি সরবরাহ কমিয়ে দিলে ১৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে কলমানির টাকা লেনদেন হয়। ব্যাংকগুলোর সিআরআর ও এসএলআর জমার পরিমাণও বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের মোট সম্পদের ১০ ভাগের বেশি টাকা যারা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ হয়েছে, তা সমন্বয় করতে সময় বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে শেয়ারবাজারের পতন ত্বরান্বিত হয়।
অথচ অনেক আগেই সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি। গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসসি) সভাপতি শাকিল রিজভী ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সভাপতি ফখরউদ্দীন আলী আহমদ শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এটা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে সেদিন তারা বলেছিলেন, বাজারে কোনো বিপর্যয় হলে এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে সেদিন তারা বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। যে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫০০ টাকা হওয়া উচিত নয়, তা এখন লেনদেন হচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে বলে তারা মন্তব্য করেন। এতে সরকার, দেশ, দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাজারে প্রচুর বিনিয়োগকারী এসেছেন। ফলে বেড়েছে শেয়ারের চাহিদা। সে অনুযায়ী বাড়েনি শেয়ারের সরবরাহ। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাই বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সরকার বার বার ঘোষণা দিয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়েনি। সিএসই সভাপতি বলেন, কাদের স্বার্থ সংরক্ষণে এসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসছে না, তাও ক্ষতিয়ে দেখার সময় এসেছে। তারা এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাজারে তালিকাভুক্ত এমন অনেক শেয়ার রয়েছে যেগুলোর পিই রেশিও ৭০ থেকে ৮০-এর ওপরে। কখনোই এসব শেয়ারের দাম এ অবস্থায় স্থায়ী হবে না। তারা মূলধন বাড়ানোর নামে প্লেসমেন্ট শেয়ার বাণিজ্যেরও সমালোচনা করেন। দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি নতুন বিনিয়োগকারীদের গুজবে কান দিয়ে অতিমূল্যায়িত শেয়ার না কেনারও পরামর্শ দেন।
কিন্তু সরকার এতে কোনো কান দেয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ সর্বনাশ করেছেন শেয়ার না ছেড়ে ডিভিডেন্ড ঘোষণা পর্যন্ত শেয়ার ধরে রাখার আহ্বান জানিয়ে। কারণ ২৫ তারিখে শেয়ার মার্কেট পুনরায় খোলার পর যতগুলো ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ঘোষণা হয়েছে সবগুলোরই দাম আশঙ্কাজনকভাবে পড়ে গেছে। গত ৩ দিনে পড়েছে ১৩শ’ পয়েন্ট। এমনকি গত মঙ্গলবার যখন বাজার প্রায় ৫শ’ পয়েন্ট বাড়ে সেদিন ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণাকারী মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের লেনদেনই শুরু হয় প্রতি শেয়ারের দাম ৬৫ টাকা কমে। শতকরা হিসেবে প্রায় ১০ ভাগেরও বেশি। (কারণ ডিভিডেন্ড ঘোষণার দিন কোন লিমিট থাকে না। একই অবস্থা হয়েছে এর আগে ৯৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণাকারী ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড বা এনবিএল-এর ক্ষেত্রে। ঐ দিন অন্যসব শেয়ারের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পড়ে গিয়েছিল এই কোম্পানির শেয়ারের দাম। সর্বশেষ গতকাল ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড বা ইবিএল-এর ক্ষেত্রে। ৫৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার পরও কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় ১০ শতাংশ কমে যায়। একইভাবে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ঘোষণার দিনে। ঐদিনে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি দাম কমে যায় ৬০০ টাকার বেশি। এভাবে অর্থমন্ত্রী যখন ডিভিডেন্ড ঘোষণা পর্যন্ত শেয়ার বিক্রি না করার জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং ব্যাংকগুলোকে আগেভাগে ডিভিডেন্ড ঘোষণার জন্য বলে দিচ্ছেন তখনও কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে এ কাজ করলেও এবার মাসখানেক আগেই ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে। কিন্তু যখনই কোনো প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ড ঘোষণা হচ্ছে তখনই শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর কথায় ডিভিডেন্ড পর্যন্ত শেয়ার ধরে রেখে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সর্বশেষ শেয়ার ধরে রেখে যদি বিনিয়োগকারীরা লাভ খেতে চান তাহলে আরও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ফলে শেয়ার ধরে রেখে লাভবান হওয়ার চিন্তা না করে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণ বর্তমানে বাজারে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে তাতে আরও বড় ধরনের দরপতন হবে বলে আশঙ্কা তাদের।
ডিসেম্বরের ৫ তারিখে ডিএসসির সূচক যেদিন সবোর্চ্চ ৮৯১৮ পয়েন্টে পৌঁছেছিল সেদিনের তুলনায় সূচক গতকাল পর্যন্ত ৩৩৩৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫৫৭৯ পয়েন্টে। সূচকের গড় পতন ৩৫ শতাংশের মতো হলেও কোনো কোনো শেয়ারের দাম এ সময় প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। ভালো মৌলভিত্তি ও পিই রেশিওধারী অনেক শেয়ারের দামও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গড়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মূলধন খুইয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। পূবালী ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন এমন একজন বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন, তিনি মধ্য নভেম্বরে প্রথমে একলাখ ও নভেম্বরের শেষ দিকে ঋণ করে মোট ৮ লাখ ও দরপতনের পর অ্যাডজাস্টের আশায় আরও প্রায় ৩ লাখসহ মোট ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন। সবগুলো এ ক্যাটাগরির ও ভাল মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগের পরও গতকাল ট্রেডিং শেষে শেয়ারের মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা। তিনি বলেন, বেস্কিমকো, উত্তরা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, পূবালীব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান তার পোর্ট ফোলিওতে রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৫ ডিসেম্বর এনবিএল-এর প্রতি শেয়ারের দাম ছিল ১৭৫ টাকা ১০ পয়সা। মাঝখানে এটা প্রায় ১৯০ টাকায় পৌঁছেছিল। কিন্তু ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর কমতে কমতে গতকাল এই শেয়ারের দাম এসে দাঁড়িয়েছে ১৪৫ টাকা ৪০ পয়সায়। ইবিএল-এর শেয়ারের দাম ৫ ডিসেম্বর ছিল ১৩৫ টাকা ১০ পয়সা। গতকাল ৫৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর এই শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায়। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ৮১৯ টাকা । এর মধ্যে এই ব্যাংকের ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা হয়েছে। গতকাল শেয়ারের দাম ছিল ৪৩২ টাকা ৫০ পয়সা। ৫ ডিসেম্বর ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ২৫০৫ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটি ৩০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। গতকাল ব্যাংকটির শেয়ারের দাম এসে দাঁড়িয়েছে ১২৩৬ টাকা।